প্রখ্যাত সাংবাদিক কামাল লোহানী না ফেরার দেশে
করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রখ্যাত সাংবাদিক কামাল লোহানী(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
শনিবার (২০ জুন) সকালে রাজধানীর মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
এর আগে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গত ১৭ জুন সকালে কামাল লোহানীকে রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে শুক্রবার (১৯ জুন) বিকেলে কামাল লোহানীকে আইসিইউতে নেয়া হয়।
দীর্ঘদিন থেকে বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন কামাল লোহানী। গত মাসেও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি।
দৈনিক মিল্লাত পত্রিকা দিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন কামাল লোহানী। এরপর তিনি আজাদ, সংবাদ, পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে দুইবার মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন কামাল লোহানী। এছাড়া তিনি উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি হিসেবে এবং ছায়ানটের সম্পাদক হিসেবে চার বছর করে দায়িত্ব পালন করেন।
কামাল লোহানী উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটেরও উপদেষ্টা ছিলেন।
কামাল লোহানীর জীবনী
মৃত্যু যদি ত্যাগের না হয়, তবে জীবনে অর্জিত সাফল্য মূল্যহীন। বিশেষ দিনে জীবনকে এভাবেই মূল্যায়ন করেছিলেন শব্দসৈনিক কামাল লোহানী। বলেছিলেন, জীবন হতে হবে দেশ ও দশের জন্য। বাঁচতে হবে ধর্ম নিয়ে, তবে ধর্মান্ধতা নয়। তবে বরেণ্য এই মানুষটির এমন শত হাজার কথা আলোকবর্তিকা হয়ে শুধু বইয়ের পাতায় নয় রইবে প্রজন্মের হৃদয়ে।
চাইলেই আর নিরুদ্দেশ যাত্রা হবেনা বাবার সাথে। সময় মিললেও প্রিয় আড্ডায় পাওয়া হবেনা বাবাকে। বাবার কাছ থেকে জানা হবেনা কতশত অজানা সব গল্প, শেখা হবেনা মানুষকে ভালোবাসার কৌশলও।
বাবাকে নিয়ে যতো আবেগ উৎকণ্ঠা, সবই যেনো নিমিষেই উধাও। হঠাৎই যে বদল হয়েছে বাবার যাপিত জীবনের ঠিকানাটা। যে আশ্রয়ে পাড়ি জমালে ফেরেনা আর কেউ। করোনা যেনো আচমকাই কেড়ে নিয়েছে সমস্ত ভালোবাসা।
কেড়ে নিয়েছে আপাদমস্তক একজন শ্বেতশুভ্র মানুষকে। যিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ কিংবা পাক-ভারত বিভাজন অথবা ৫২ ৬৯ আর ৭১ এর চাক্ষুষ সাক্ষীই শুধু নন, ছিলেন একজন সক্রিয় সৈনিকও, ছিলেন কলমযেদ্ধা। বলছি প্রখ্যাত সাংবাদিক কামাল লোহানীর কথা।
আগ্রাসী যমুনার গর্ভে যখন ভিটেমাটি ঠিক তখনই মায়ের গর্ভে জন্ম তাঁর। ১৯৩৪ সালে ২৬ জুন, সিরাজগঞ্জের সনতলা গ্রামে। আর তাই বুঝি ছোট থেকেই ছিলেন দূরন্ত-দূর্বার। জীবনের সহজপাঠ ওপার বাংলায় হলেও, উচ্চশিক্ষার নৌকাটা নোঙর ফেলেছিলো এপারেই। যদিও তা ছিলো উচ্চমাধ্যমিক অবধিই।
বর্ণাঢ্য জীবন ছিলো তাঁর। সাংবাদিকতার সাক্ষরে রেখে গেছেন নিজস্বতার ছাপ। করেছেন রাজনীতি, হয়েছেন রাজবন্দীও। সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও ছিলেন পথিকৃৎ। কি ভাষা আন্দোলন কিবা মুক্তিযুদ্ধ তাঁর স্বপ্নাতুর চোখ জুড়ে ছিলো বিপ্লবের ঐশ্বর্য্য। গ্রন্থনা উপস্থাপনা আর আবৃত্তিতেও ছিলেন অগ্রগণ্য। চলচ্চিত্রের উঠোনেও হেঁটেছিলেন কিছুটাদিন।
ছিলেন বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট এর প্রকাশনা পরিচালক, বাংলা একাডেমি আর শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকও। এছাড়া রাজশাহী আর্ট কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও ছিলেন তিনি। লিখেছেন বই, পেয়েছেন একুশে পদক সহ নানা সম্মাননাও।
দেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে তাঁর কণ্ঠ, কথা বলেছে তাঁর কলম আর তিনিও হয়ে উঠেছেন একজন কিংবদন্তী।
বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণে যিনি মাত্র পাঁচ লাইনে লিখেছিলেন বিজয়ের প্রথম বার্তাটি তাঁর এই শেষপ্রস্থানে রেখে যাওয়া ৮৬ বসন্তের শত হাজার বার্তায় রয়ে যাবেন তিনি একটি উজ্জ্বল আলেঅকবর্তিকা হয়েই।
h